তিন পাগলের গল্প
-দীপালী পাল
বাড়ি খুঁজছেন মৃগাঙ্ক বাবু,একটা বাড়ি কিনবেন,পৈতৃক বাড়িতেই এখন থাকেন।তিনভাই সবাই বিবাহিত, সবার বৌ, ছেলেপুলে আছে, দোতলা বাড়ি,একটা অবিবাহিত বুদ্ধিহীন বোনও আছে। মৃগাঙ্ক বাড়ি কিনবেন, বৌ আবদার করেছে বলে কথা।একদম নিজস্ব একটা বাড়ি চাই।এই ভাগের বাড়িতে কুড়ি বছর ধরে অনেক উপদ্রব,জ্বালাতন সহ্য করতে হয়েছে।এইবার নিজস্ব,একেবারে নিজস্ব একটা বাড়ি চাই।মৃগাঙ্ক বাবু তিনজন দালাল কে বলেছেন বাড়ি দেখানোর জন্য।তিনজনে ফোন করে করে প্রায় প্রতি রবিবার ই ডেকে নিয়ে গিয়ে বাড়ি দেখাচ্ছে কিন্তু একটা বাড়ি ও তার পছন্দ মতো হচ্ছেনা।কোনোটার জায়গার পরিমান খুবই কম ,কোনোটায় ঘরগুলো খুব ছোট ছোট ,কোনোটায় বা আলোবাতাস ঠিকমতো ঢোকেনা,আবার যেটা পছন্দ সই হয় সেটার আকাশ ছোঁয়া দাম।শনিবার বিকালে দালাল কেষ্ট ফোন করে বলল-“দাদা একটা দারুন দোতলা বাড়ি আছে , দাম মাত্র ত্রিশ লাখ টাকা, কাল বিকেল চারটের সময় আসুন দেখিয়ে দেবো”
“ইয়ে মানে তুমি কোথায় থাকবে?”
“আমি সতীশের মুদি দোকানের সামনে দাঁড়াবো,ঠিক চারটে,মনে থাকে যেন”
“আচ্ছা”
পরের দিন মৃগাঙ্ক বাবু কেষ্টর সাথে বাড়ি দেখতে গেলেন।
অনেকটা অলিগলি দিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে তা পার হয়ে প্রায় দু কিলোমিটার এগলি ওগলি ঘুরতে ঘুরতে একটা পুরনো রংচটা বাড়ি দেখা গেল,কেষ্ট তার সরু সরু আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল -“ঐ যে মৃগ দা এসে গেছি,ঐ যে ঐ বাড়িটা,”
“আচ্ছা,,”
বাড়ির সামনে আসতেই সামনে একটা ছোট দু পাদানির সিড়ি, তার পাশে ডান দিকে তাকাতেই মৃগাঙ্গের হঠাৎ করে বমি পেয়ে গেল ,খানিকটা পানের পিকের আর চিবানো পানের স্তুপ ,,
ওয়াক আসছে এসব দেখে,সে বলে উঠলো”বাড়ির লোকগুলো কি নোংরা রে বাবা,ছিঃ”
দরজা খুলে দিল বছর পচিশের একটা ছিপছিপে চেহারার ছেলে,গায়ের জামাটা ভীষন নোংরা ,দেখলে মনে হচ্ছে জামাটা অনেকদিন কাচেনি।দাঁত গুলো একেবারে হলুদ,গায়ে বনমানুষের মতো ভটকা গন্ধ,
যাইহোক ছেলেটি তাদের কে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল,একতলার দুটো ঘরই অন্ধকার!
সমস্ত ঘরময় মাকড়সার জাল ভর্তি হয়ে আছে। দেখে মনেহচ্ছে যেন এখানে মানুষ নয় ভুতেরা বাস করে।ঘরের মধ্যে একটা বাজে গন্ধ,ঠিক যেমন পাখী বা বাঘের খাঁচায় যেমন গন্ধ থাকে ঠিক তেমনি একটা গন্ধ। মৃগাঙ্ক বাবু আর কেষ্ট দুজনে অবাক হয়ে চারিদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখছে আর ভাবছে “কি অদ্ভুত বাড়িটা।”
দুটি ঘর পেরিয়ে একটা ঘরে আলো জ্বলছে।সেই ঘরে চুড়িদার পরা একটা বছর ষাটের মহিলা ও একজন টাকমাথা বছর সত্তরের বয়স্ক লোক দুজনে খাটের উপর বসে টিভি দেখছে, ছেলেটির বাবা মা বোধহয়।বুড়ো লোকটা খাটের পাশেই চেয়ার দেখিয়ে চোখ ঘুরিয়ে ওদের বসতে বললেন,মহিলা টা এক দৃষ্টে টিভি দেখেই যাচ্ছে। অনেকক্ষন বসে থাকার পর মৃগাঙ্ক ও কেষ্ট মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো,কেষ্ট বলল”
আমাকে পটল মানে পরিমল দাস পাঠিয়েছে, মেসোমশায় এই ভদ্রলোক বাড়িটা কিনতে চায়”
লোকটা হঠাৎ খাটের উপর দাড়িয়ে বলল “আমার বাড়ি কিনতে চায় ,কি মজা!কি মজা!খুব ভালো খুব ভালো ,চলুন সব ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখাই,ঘুরে ঘুরে দেখাই”।
এবার বৃদ্ধ ,বৃদ্ধা দুজনেই ঘুরে ঘুরে ঘরগুলো দেখাতে লাগলো, রান্নাঘরে জলের বোতল আছে প্রায় দুশো টা সব বোতলে জল ভর্তি আর মেঝেতে ছড়ানো রয়েছে।মৃগাঙ্ক এমনটা দেখে খুব আশ্চর্য্য হয়ে গেল।অবাক কান্ড!ওর যেন কেমন অদ্ভুদ ধরনের লাগলো। এতো গুলো বাড়ি দেখেছে এরকম ও আগে কখনও দেখেনি। যাইহোক মৃগাঙ্ক ও কেষ্ট ওদের সাথে ওপরের তলার গেল ঘরগুলো দেখতে গেল ,বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার পেছনে তার ছেলেটি আসছে ,কিন্তু দোতলার ঘরগুলো দেখে খুবই ঘেন্না পেলো সমস্ত ঘরে মাকড়সার বড় বড় জালের মধ্যে অজস্র মশা ,টিকটিকি,মাকড়শা,কীট পতঙ্গের মড়া ঝুলছে,
মৃগাঙ্ক আর দেরী না করে বলল”কি নোংরা আপনারা ঘরটা পরিস্কার করে রাখেন নি কেনো? ইস্ কি বাজে একটা গন্ধ বেরোচ্ছে”
এই কথা শুনে লোকটি আর মহিলাটা খিল খিল করে হেসে বার ছয়েক হাততালি দিয়ে দুই হাত তুলে নাচতে নাচতে বলল”এই জন্য তো কেউ আমাদের বাড়িতে কেউ আসেনা,কেউ দেখতে এলেও কেনেনা,কিনতে হবেনা ,হা,হা,হা,হা….”।
মৃগাঙ্কের মুখের সামনে মুখ নিয়ে বৃদ্ধ হঠাৎ প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলল “তোমার এতোবড়ো সাহস,আমার এতো পরিচ্ছন্ন বাড়িটাকে নোংরা বলছো,তোমাকে আজ দেখাব মজা বলেই মা,বাবা,ছেলে তিনজনে হাততালি দিয়ে হাহাহা করে হাসতে শুরু করল।
মৃগাঙ্ক বুঝে গেল এরা সব পাগল,কেষ্ট ও খুব অবাক হয়ে গেল,পাড়ার ছেলে পটল ওকে দুদিন আগে এই বাড়িটার সন্ধান দিয়ে বলেছে মালিকের সাথে কথা বলে রেখেছে ,আর শেষে কিনা একটা পাগলের বাড়ির ঠিকানা দিল। হঠাৎ বুড়ো আর বুড়ি দুজনে মৃগাঙ্কর হাত দুটো শক্ত করে টিপে ধরে বলল”তোমাদের বাড়ি দেখা হয়ে গেলেও যেতে দেবোনা আমরা আজ তোমাদের কাউকে ছাড়বো না,তোমাদের নাচ দেখবো, দেখাবো,গান গাইবো ,শুনবো তবে ছাড়বো”।
মৃগাঙ্ক এক ঝাপটা মেরে বলল “ছাড়ুন বলছি,কি অসভ্য লোক রে বাবা,ছাড়ুন পাগল কোথাকার!”
কেষ্ট কে চেপে ধরেছে ওদের ছেলেটা,আর বলছে “তুমি একটা গান শোনাও আমাদের,,তোমাকে শোনাতেই হবে বুঝলে।”
কেষ্ট হাত জোড় করে চোখ মুখ কাঁচু মাঁচু করে বলল-“এবারের মতো ছেড়ে দাও বাবা পরে একদিন এসে অনেক গান শোনাবো,এই মৃগ দা চলো চলো,আমরা বাইরে বেরিয়ে যাই।”
মহিলাটা একথা শোনামাত্র নাক মুখ ফুলিয়ে সিংহের মতো গর্জন করে উঠল আর তৎক্ষনাৎ দৌড়ে গিয়ে বাড়ির সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দিল।দৌড়ে ওরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ওরা তিনজনে প্রচন্ড শক্তি প্রয়োগ করে ওদের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল,তিনজনের গায়ে কি শক্তি রে বাবা,এবার মহিলাটা জোর গলায় গান শুরু করল, “আ,আ,আ,আ,আ,শঙ্কর ভোলা,,, পার্বতী রমনী ,,কৈলাস বাসীইইইইই”আর লোকটা ঘরময় খ্যামটা নাচ নাচতে শুরু করে দিল।দুম্ দুম্ করে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরের এদিক থেকে ওদিকে দৌড়চ্ছে আর বলছে “ইউরেকা ইউরেকা পেয়েছি শিকার এবার পুড়িয়ে মাংস খাবো আর হাড় দিয়ে ডুগডুগি বাজাবো”।
মৃগাঙ্গর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল এই কথা শুনে ,কি যে করবেন বুঝতে পারছিলেন না কিছুই কেমন যেন হতভম্ভ হয়ে গেলেন ।এদিকে ওদের ছেলেটা একটা বড় থালা এনে বাজাতে শুরু করল আর নাচ শুরু করল সাথে বেসুরো গান ও গাইল “ডফলিওয়ালে ডফলি বাজা “
মৃগাঙ্ক প্রানপনে চিল্লাচ্ছেন “বাঁচাও ,বাঁচাও কে আছো আমাদের বাঁচাও,কেষ্ট তুমি আমাকে এ কোথায় নিয়ে এলে?”
“আমি জানতাম না কিচ্ছু জানতাম না যে এরা সবাই পাগলের গুষ্টি- জোরে চিল্লান দাদা,কেউ যদি শুনতে পেরে আমাদের বাঁচায়,কি আশ্চর্য্য ফোন দুটোও ওরা কেড়ে নিয়েছে”
এদিকে লোকটা নাচছে আর দাঁত কিড়মিড় করে মৃগাঙ্কের চোখে বার বার ফু দিচ্ছে। অসহ্য লাগছে ওদের, ভয় ও পাচ্ছে, পাগল গুলো কি করবে ওদের নিয়ে কে জানে! বাপের জন্মেও এই রকম অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি ।কেষ্টর পা দুটো ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে, ছেলেটা একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে কেষ্টর মুখের সামনে নাড়িয়ে বলছে “তুমি পপ গান গাও,নাহলে তোমাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলবো”
কেষ্ট গলায় যতো জোর আছে সবটা দিয়ে জোর কদমে “বাঁচাও” বাঁচাও বলে চিৎকার করতে লাগলো।
ঠিক ঐ সময় পাড়ার একজন সহৃদয় ব্যক্তি বিকেলে রাস্তায় হাঁটছিলেন মেদ ঝরানোর জন্য ,এরকম চিৎকার চেঁচামেচি শুনে উনি ফোন করে লোকাল থানায় খবর দিলেন। আগেও এরকম ঘটনা কয়েক বার ঘটেছে কিনা!
পুলিশ এসে শেষ মেষ ওদের সেই পাগল পরিবারের হাত থেকে বাঁচালো। মৃগাঙ্ক বাবু হাঁফ ছেড়ে প্রতিজ্ঞা করেছেন কেষ্টর সাথে বাড়ি দেখতে আর কোনোদিন যাবেন না।বাবা,ঐ পাগল গুলোর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন এটাই বড় কথা। জীবনে পাগল তো অনেক দেখেছেন এমন সাংস্কৃতিক,অদ্ভুত পাগল কোনোদিনও চোখে পড়েনি।এবার থেকে ভালো করে না জেনেশুনে আর কারোর সাথে বাড়ি দেখতে যাবেন না,মনে মনে বললেন”জয় মা কালি,এ যাত্রা বড় বাঁচান বাঁচিয়ে দিলে মা”।।